ইতিহাসের উষ্ণতম বছর হতে চলেছে ২০২৩

গত সেপ্টেম্বর মাসটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ সেপ্টেম্বর। এর আগে আর কোনো সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের মতো এত উষ্ণ ছিল না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ুবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের (থ্রিসিএস) প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসের গড় তাপমাত্রা দেখে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০২৩ সালটিও ইতিহাসের উষ্ণতম বছর হওয়ার পথে আছে।

কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের গড় তাপমাত্রা আগের যেকোনো বছরের প্রথম ৯ মাসের গড় তাপমাত্রার চেয়ে শূন্য দশমিক ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (শূন্য দশমিক ৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) ফারেনহাইট বেশি ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগে বছরের প্রথম ৯ মাসে সবচেয়ে বেশি গরম ছিল ২০১৬ সালে। আর ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের তাপমাত্রা তার চেয়েও শূন্য দশমিক শূন্য ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।

২০২৩ সালে সবচেয়ে চরম আবহাওয়া দেখা গেছে সেপ্টেম্বরে। মাসটির ৩০ দিনে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৬ দশমিক ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়। ১৯৯১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রেকর্ড করা মাসিক সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রার চেয়ে তা শূন্য দশমিক ৯৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা দ্রুত বাড়ছে। এ কারণে আবহাওয়া চরম রূপ নিচ্ছে। ঘন ঘন ঝড়ের তাণ্ডবের মূল কারণ হিসেবে সেই বিষয়টিকেই চিহ্নিত করে আসছেন বিজ্ঞানীরা।

চলতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চরম উষ্ণতার পাশাপাশি প্রবল বর্ষণও দেখা গেছে। গত সেপ্টেম্বরেও ছিল চরম আবহাওয়ার দাপট। এ মাসে গ্রিসে যেমন ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলের তাণ্ডব চলেছে, প্রবল বৃষ্টির কারণে বন্যাও হয়েছে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে। লিবিয়াতেও হয়েছে ভয়াবহ বন্যা। বন্যায় বিপর্যস্ত হয়েছে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর দারনা, কয়েক হাজার মানুষের প্রাণও কেড়ে নিয়েছে বন্যা।


জুলাই ছিল উষ্ণতম মাস

চলতি বছরের জুলাই ছিল বিশ্বের বুকে সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জলবায়ুবিষয়ক পর্যবেক্ষণ সংস্থা কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস বলছে, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বিশ্বের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ১৬ দশমিক ৬৩ ডিগ্রি (৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) রেকর্ড করা হয়েছিল। তবে গত মাসে এর চেয়েও শূন্য দশমিক ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা ছিল।

জুলাইয়ে বিশ্বজুড়ে দাবদাহ ছিল উল্লেখ করে ইইউর জলবায়ুবিষয়ক পর্যবেক্ষণ সংস্থাটি আরও বলেছে, চলতি বছরের জুলাই মাসটি ১৯৯১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সব জুলাই মাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ ছিল।

কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের উপপরিচালক সামান্থা বার্জেস বলেন, আমরা গত জুলাই মাসে বৈশ্বিক বায়ুমণ্ডল ও মহাসাগরের পৃষ্ঠের রেকর্ড তাপমাত্রার সাক্ষী হলাম। এই রেকর্ড তাপমাত্রা মানুষ ও এই গ্রহ উভয়ের জন্য খারাপ পরিণতি ডেকে আনবে।

গত ১৮ শতকের শেষের দিক থেকে এ পর্যন্ত বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রায় ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এর প্রধান প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। এতে করে তাপপ্রবাহের মাত্রা ও সংখ্যা দুই-ই বেড়েছে। পাশাপাশি আবহাওয়া চরম আকার ধারণ করেছে-বাড়ছে ঝড় ও বন্যা।

এর আগে জুলাই মাসের শেষের দিকে কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস ও জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) জানিয়েছিল, জুলাইয়ের প্রথম ২৩ দিনের গড় তাপমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ৬ জুলাই ছিল বিশ্বের উষ্ণতম দিন।


সবচেয়ে উষ্ণ হতে পারে আগামী পাঁচ বছর 

আগামী পাঁচ বছর এযাবৎকালের সবচেয়ে উষ্ণ সময় পার করতে পারে বিশ্ব। এই সময়ের মধ্যেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখার যে লক্ষ্য, সেই সীমাও ছাড়িয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা ডব্লিউএমও এ সতর্কবার্তা দিয়েছে।

বিশ্বে এযাবৎকালের সবচেয়ে উষ্ণ যে আট বছর রেকর্ড হয়েছে, সেগুলো সবই ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা আরও বাড়ার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। ডব্লিউএমও বলেছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কমপক্ষে একটি বছর এবং সব মিলিয়ে এই পাঁচ বছর সময়কাল সবচেয়ে উষ্ণ হবে। সংস্থাটি বলেছে, ২০২৩–২০২৭ সালের মধ্যে অন্তত একটি বছরে বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের বার্ষিক তাপমাত্রা শিল্পায়নপূর্ব সময়ের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হবে।

২০১৫ সালে হওয়া প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে চলতি শতকের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশ কম, সম্ভব হলে দেড় ডিগ্রির মধ্যে আটকে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে মতৈক্য হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির এই হিসাব হবে ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যকার গড় তাপমাত্রার তুলনায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বছর বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ছিল ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যকার গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

ডব্লিউএমওর প্রধান পেটেরি তালাস বলেছেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো এক বছর বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ার অর্থ এটা স্থায়ী রূপ পাচ্ছে তা নয়। তবে অস্থায়ীভাবে এ ধরনের ঘটনা বাড়ার বিষয়ে ডব্লিউএমও সতর্ক করছে। তিনি বলেছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আবহাওয়ায় এল নিনো (উষ্ণ সামুদ্রিক স্রোত) প্রভাব শুরু হতে যাচ্ছে। এর সঙ্গে মানুষের নানা কর্মকাণ্ডে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। স্বাস্থ্য, খাদ্যনিরাপত্তা, পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। এ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //